১২:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

ফিলিস্তিনে বসবাস করত যে সব নবী-রাসূল

  • ঢাকা ডেস্ক
  • সর্বশেষ আপডেট : ১২:৪৯:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫
  • 19

ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর অন্যতম পূণ্য ভূমি ফিলিস্তিন । এজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ ভূমিতে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসুল। মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর পর সবচেয়ে দামি মসজিদ সেখানেই অবস্থিত। মসজিদুল আকসা।

এ পবিত্র স্থান তথা মসজিদের আশপাশকে আল্লাহ তা’আলা বরকতময় করেছেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি। তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত নম্বর-১)

পুন্যভূমি এ ফিলিস্তিন নিজের বুকে যতজন নবী-রাসুল ধারণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো ভূমি সেটা পারেনি। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ. থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রায় সব নবী এ ভূমিতেই এসেছিলেন। আজ কথা বলবো সেসব নবী-রাসুলদের নিয়ে, যারা ধন্য করেছিলো ফিলিস্তিনের এ পুন্য ভূমিকে।

মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম খলিলুল্লাহ। ইরাকের বাবেল শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছাতে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হন তিনি। এক আল্লাহর ইবাদতের অপরাধে তার বাবা তাকে দেশান্তরিত করার হুমকি দেয়।

এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘হে ইবরাহিম। তুমি তি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? যদি তুমি বিরত না হও তবে অবশ্যই আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করবো। আর তুমি চিরতরে আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও।’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত নম্বর- ৪৬)

ঈমান রক্ষায় স্ত্রী সারা, ভাতিজা লুতসহ প্রথমে হাররান, সেখান থেকে হালবে তারপর ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরত করেন ইবরাহিম (আ.)। (আতলাসুল কোরআন ৩০) ফিলিস্তিনেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। জেরুজালেমেই তাকে সমাহিত করা হয়। (কাসাসুল কোরআন ২য় খণ্ড ১৬৪ পৃষ্ঠা)

ফিলিস্তনে যে সব নবীদের জন্ম বা বসবাস করছেন:

ইসমাঈল (আ.)-এর জন্মস্থান ফিলিস্তিন

বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরতের পর দীর্ঘ ২০ বছর নিঃসন্তান থাকেন ইবরাহিম (আ.)। বিবি সারা ইবরাহিম (আ.) কে বললেন, আল্লাহ আমাকে সন্তান দেননি। আপনি আমার দাসী হাজেরাকে বিয়ে করেন। হতে পারে আল্লাহ তার থেকে সন্তান দান করবেন। হাজেরার গর্ভে ফিলিস্তিনে ইসমাঈল আ. জন্মগ্রহণ করেন (কাসাসুল আম্বিয়া ১-২০০)। এরপর আল্লাহর আদেশে শিশু ইসমাঈলসহ হাজেরাকে মক্কায় রেখে আসেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক। আমি আমার কিছু বংশধরকে আপনার সম্মানিত ঘরের আশপাশে বসবাস করিয়েছি, এমন এক উপত্যকায়, যেখানে কোনো ক্ষেত-খামার নেই। হে আমাদের প্রতিপালক। (এটা আমি এজন্য করেছি) যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে দিন। তাদেরকে ফলমূলের রিজিক দান করুন। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত নম্বর-৩৭) হযরত ইসমাঈল (আ.) মক্কায় সারাজীবন কাটিয়ে দেন। মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত হন।

হযরত  ইসহাক (আ.)-এর জন্মভূমি ফিলিস্তিন

হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বিতীয় ছেলে ইসহাক আ.। স্ত্রী সারার গর্ভ থেকে ইসহাক আ.-এর জন্মের সুসংবাদ এমন সময় পেয়েছেন, যখন উভয়ে শেষ বয়সে উপনীত হন। যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ইবরাহিম আ. বলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দিয়েছেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক অত্যাধিক দোয়া শ্রবণকারী। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত নম্বর ৩৯)

ইসহাক আ. ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ইবরাহিম আ.-এর সঙ্গে সেখানেই বসবাস করেন। তিনি ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। সেখানেই কবরস্থ হন। (আতলাসুল কোরআন ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠা)

হযরত নবী লুত (আ.)-এর বসবাস ফিলিস্তিনে

হযরত লুত (আ.)-এর বসবাস ছিলো বৃহত্তর ফিলিস্তিনে। তিনি ইবরাহিম আ.-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তার সঙ্গে ফিলিস্তিনে হিজরত করেছিলেন। পরবর্তীতে ইবরাহিম আ.-এর পরামর্শে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা সাদুম ও আমুরায় চলে যান। ঐহিতাসিকদের বর্ণনা মতে যা বর্তমান মৃত সাগর ও তার তীরবর্তী এলাকা। সেখানকার লোকেরা নিকৃষ্ট ও ঘূর্ণিত স্বাভাবের ছিলো। তারা সমকামিতায় আসক্ত ছিলো।

লুত (আ.) তাদের এহেন ঘৃণিত কাজ থেকে বিরত থাকতে বললেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে নিজ জাতিকে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছো, যা তোমাদের আগে সারাবিশ্বের কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো। বরং তোমরা সীমালঙ্ঘন করছো। (সুরা আরাফ, আয়াত নম্বর ৮০, ৮১)

এ ঘৃণিত অপরাধের কারণে সাদুম ও আমুরাবাসীর ওপর আসমানি গজব নেমে আসে। আল্লাহর হুকুমে লুত আ. পাশ্ববর্তী পাহাড়ে চলে যান। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন। (কাসাসুল কোরআন ২য় খণ্ড ১৫৪ পৃষ্ঠা)

হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর মাতৃভূমি ফিলিস্তিন

ইয়াকুব (আ.) যার অপর নাম ইসরাঈল। তিনি ইসহাক আ. ছেলে। ইবরাহিম (আ.) এর নাতি। জন্ম ফিলিস্তিনে। ভাই ইসুর সঙ্গে মনোমালিন্য হলে, মা রাফকার পরামর্শে তিনি দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে চলে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর স্ত্রী-সন্তানসহ ফিলিস্তিনে চলে আসেন (কাসাসুল কোরআন-২ : ১৬৬)। ইয়াকুব আ.-এর বারোজন ছেলে ছিল।

শেষ বয়সে মিশরে হিজরত করেছিলেন তিনি। সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। মিশরেই তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি সন্তানদের ওয়াসিয়ত করেছিলেন, মিশর ত্যাগকালে তার লাশ যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়া হয়। ওয়াসিয়ত অনুযায়ী তার লাশ ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয়। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি বাইতুল মুকাদ্দাসে সমাহিত করা হয় (আতলাসুল কোরআন ৩৫)।

হযরত ইউসুফ (আ.)-এর শৈশব কাটে ফিলিস্তিনে

আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ আ.। যার ঘটনাকে কোরআন আহসানুল কাসাস বলেছে। তিনি হযরত ইয়াকুব আ.-এর ছেলে। দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। এরপরই পিতা ইয়াকুব আ.-এর সঙ্গে ফিলিস্তিনে চলে আসেন। শৈশবের কিছুদিন ফিলিস্তিনেই কাটে তার। ছোটবেলায় তিনি ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। পরে নবুয়াত লাভ করার পর মিশরের মন্ত্রী হন।

নিজের পিতা ও ভাইদের মিশর নিয়ে আসেন। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। তবে মৃত্যুকালীন ওয়াসিয়ত অনুযায়ী তার লাশকেও ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে স্থানান্তরিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৪৮ নম্বর পৃষ্ঠা)

ফিলিস্তিনের বাদশাহ ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)

হযরত দাউদ (আ.)। তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের বাদশাহ ও নবী ছিলেন। পাহাড়-পর্বত পাখিরা দাউদ আ. এর অনুগত ছিল। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি দাউদকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ দান করেছি। হে পাহাড়-পর্বত, হে পাখিরা, তোমরাও দাউদের সঙ্গে আমার তাসবিহ পড়। আর আমি তার জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলাম। (সুরা সাবা আয়াত নম্বর ১০)

নবুয়াত লাভের আগে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তালুতের দলে যুদ্ধে শরিক হন। অত্যাচারী বাদশাহ জালুতকে তিনি হত্যা করেন। আসদুদ, বাইতে দুজান, আবু গাওস, বাইতুল মুকাদ্দাস ও রামলার শাসক ছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে রামলাগামী পথের ডানপার্শ্বে একটি পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৬৪ নম্বর পৃষ্ঠা)

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মাতৃভূমি ফিলিস্তিন

হযরত সুলাইমান আ. হযরত দাউদ আ.-এর ছেলে। আল্লাহর নবী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গোটা পৃথিবী শাসনকারী শাসকদের অন্যতম। আল্লাহ তাআলা পশু-পাখি, বায়ুমণ্ডল ও জিন জাতিকে তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এই মহান নবীর জন্ম, বসবাস সবই ছিলো ফিলিস্তিন কেন্দ্রিক। তিনি ঐতিহাসিক বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদের নির্মাতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৯২৩ সালে ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে তাকে দাফন করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৬৮ নম্বর পৃষ্ঠা)

ইয়াহইয়া (আ.)-এর জন্মস্থান ফিলিস্তিন

আল্লাহর আরেক নবী হযরত ইয়াহইয়া আ.-এর জন্ম লিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে। হযরত জাকারিয়া আ.-এর দোয়ায় আল্লাহ তাআলা বৃদ্ধ বয়সে দান করেন ছেলে ইয়াহইয়া আ.-কে। তার মর্যাদা, তাকওয়া, জনপ্রিয়তা ও আল্লাহর দিকে আহ্বান-এর কারণে তিনি ইহুদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার কারণে বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরে তাকে শহিদ করা হয়। (কাসাসুল কোরআন ৭ নম্বর খণ্ড ৬২ পৃষ্ঠা)

কিয়ামতের আগে হযরত ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনেই নেমে আসবেন

ঈসা ইবনে মারইয়ামের জন্ম ফিলিস্তিনের বাইতুল লাহামে। যিনি পিতা ব্যতীত আল্লাহর কুদরতের সাক্ষী হিসেবে দুনিয়াতে আগমন করেন। তিনি দোলনায় থাকাবস্থায় নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দেন। মায়ের সতীত্বের সাক্ষ্য দেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন,

মারইয়াম বলল, আমার ছেলে হবে কীভাবে, অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। আমি কোনো ব্যভিচারিণীও নই। ফেরেশতা বলল এভাবেই হবে। তোমার রব বলেছেন, আমার পক্ষে এটা একটি মামুলি কাজ। আমি এটা এজন্য করবো, যেনো একে আমি মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে রহমত বানাতে পারি। এটি একটি স্থিরকৃত বিষয়। (সুরা মারইয়াম, আয়াত নম্বর ২০ ও ২১ )

তিনি ফিলিস্তিন অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করেন। মায়ের সঙ্গে মিশরেও গমন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে আবার ফিলিস্তিনে চলে আসেন। অভিশপ্ত ইহুদিরা তাকে জারজ সন্তান ও তার মাকে দুশ্চরিত্রা বলে অপবাদ দেয়। তিনি তাদের বিপক্ষে আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করেন। আল্লাহর গজব নেমে আসে ইহুদিদের উপর।

তারা হযরত ঈসা (আ.)কে হত্যার পরিকল্পনা করে। আল্লাহ তাআলা তাকে নিজ কুদরতে জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নেন। কিয়ামতের আগে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে নেমে আসবেন। দাজ্জাল কে হত্যা করবেন। ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন। এরপর তার মৃত্যু হলে নবীজির রওজার পাশে সমাহিত হবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সেভ করুন

ফিলিস্তিনে বসবাস করত যে সব নবী-রাসূল

সর্বশেষ আপডেট : ১২:৪৯:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫

পৃথিবীর অন্যতম পূণ্য ভূমি ফিলিস্তিন । এজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ ভূমিতে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসুল। মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর পর সবচেয়ে দামি মসজিদ সেখানেই অবস্থিত। মসজিদুল আকসা।

এ পবিত্র স্থান তথা মসজিদের আশপাশকে আল্লাহ তা’আলা বরকতময় করেছেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি। তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত নম্বর-১)

পুন্যভূমি এ ফিলিস্তিন নিজের বুকে যতজন নবী-রাসুল ধারণ করার সৌভাগ্য লাভ করেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো ভূমি সেটা পারেনি। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ. থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রায় সব নবী এ ভূমিতেই এসেছিলেন। আজ কথা বলবো সেসব নবী-রাসুলদের নিয়ে, যারা ধন্য করেছিলো ফিলিস্তিনের এ পুন্য ভূমিকে।

মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম খলিলুল্লাহ। ইরাকের বাবেল শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছাতে গিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হন তিনি। এক আল্লাহর ইবাদতের অপরাধে তার বাবা তাকে দেশান্তরিত করার হুমকি দেয়।

এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘হে ইবরাহিম। তুমি তি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? যদি তুমি বিরত না হও তবে অবশ্যই আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করবো। আর তুমি চিরতরে আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও।’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত নম্বর- ৪৬)

ঈমান রক্ষায় স্ত্রী সারা, ভাতিজা লুতসহ প্রথমে হাররান, সেখান থেকে হালবে তারপর ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরত করেন ইবরাহিম (আ.)। (আতলাসুল কোরআন ৩০) ফিলিস্তিনেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। জেরুজালেমেই তাকে সমাহিত করা হয়। (কাসাসুল কোরআন ২য় খণ্ড ১৬৪ পৃষ্ঠা)

ফিলিস্তনে যে সব নবীদের জন্ম বা বসবাস করছেন:

ইসমাঈল (আ.)-এর জন্মস্থান ফিলিস্তিন

বাইতুল মুকাদ্দাসে হিজরতের পর দীর্ঘ ২০ বছর নিঃসন্তান থাকেন ইবরাহিম (আ.)। বিবি সারা ইবরাহিম (আ.) কে বললেন, আল্লাহ আমাকে সন্তান দেননি। আপনি আমার দাসী হাজেরাকে বিয়ে করেন। হতে পারে আল্লাহ তার থেকে সন্তান দান করবেন। হাজেরার গর্ভে ফিলিস্তিনে ইসমাঈল আ. জন্মগ্রহণ করেন (কাসাসুল আম্বিয়া ১-২০০)। এরপর আল্লাহর আদেশে শিশু ইসমাঈলসহ হাজেরাকে মক্কায় রেখে আসেন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক। আমি আমার কিছু বংশধরকে আপনার সম্মানিত ঘরের আশপাশে বসবাস করিয়েছি, এমন এক উপত্যকায়, যেখানে কোনো ক্ষেত-খামার নেই। হে আমাদের প্রতিপালক। (এটা আমি এজন্য করেছি) যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে দিন। তাদেরকে ফলমূলের রিজিক দান করুন। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত নম্বর-৩৭) হযরত ইসমাঈল (আ.) মক্কায় সারাজীবন কাটিয়ে দেন। মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত হন।

হযরত  ইসহাক (আ.)-এর জন্মভূমি ফিলিস্তিন

হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর দ্বিতীয় ছেলে ইসহাক আ.। স্ত্রী সারার গর্ভ থেকে ইসহাক আ.-এর জন্মের সুসংবাদ এমন সময় পেয়েছেন, যখন উভয়ে শেষ বয়সে উপনীত হন। যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ইবরাহিম আ. বলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দিয়েছেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক অত্যাধিক দোয়া শ্রবণকারী। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত নম্বর ৩৯)

ইসহাক আ. ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ইবরাহিম আ.-এর সঙ্গে সেখানেই বসবাস করেন। তিনি ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। সেখানেই কবরস্থ হন। (আতলাসুল কোরআন ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠা)

হযরত নবী লুত (আ.)-এর বসবাস ফিলিস্তিনে

হযরত লুত (আ.)-এর বসবাস ছিলো বৃহত্তর ফিলিস্তিনে। তিনি ইবরাহিম আ.-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তার সঙ্গে ফিলিস্তিনে হিজরত করেছিলেন। পরবর্তীতে ইবরাহিম আ.-এর পরামর্শে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা সাদুম ও আমুরায় চলে যান। ঐহিতাসিকদের বর্ণনা মতে যা বর্তমান মৃত সাগর ও তার তীরবর্তী এলাকা। সেখানকার লোকেরা নিকৃষ্ট ও ঘূর্ণিত স্বাভাবের ছিলো। তারা সমকামিতায় আসক্ত ছিলো।

লুত (আ.) তাদের এহেন ঘৃণিত কাজ থেকে বিরত থাকতে বললেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে নিজ জাতিকে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছো, যা তোমাদের আগে সারাবিশ্বের কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো। বরং তোমরা সীমালঙ্ঘন করছো। (সুরা আরাফ, আয়াত নম্বর ৮০, ৮১)

এ ঘৃণিত অপরাধের কারণে সাদুম ও আমুরাবাসীর ওপর আসমানি গজব নেমে আসে। আল্লাহর হুকুমে লুত আ. পাশ্ববর্তী পাহাড়ে চলে যান। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন। (কাসাসুল কোরআন ২য় খণ্ড ১৫৪ পৃষ্ঠা)

হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর মাতৃভূমি ফিলিস্তিন

ইয়াকুব (আ.) যার অপর নাম ইসরাঈল। তিনি ইসহাক আ. ছেলে। ইবরাহিম (আ.) এর নাতি। জন্ম ফিলিস্তিনে। ভাই ইসুর সঙ্গে মনোমালিন্য হলে, মা রাফকার পরামর্শে তিনি দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে চলে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর স্ত্রী-সন্তানসহ ফিলিস্তিনে চলে আসেন (কাসাসুল কোরআন-২ : ১৬৬)। ইয়াকুব আ.-এর বারোজন ছেলে ছিল।

শেষ বয়সে মিশরে হিজরত করেছিলেন তিনি। সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন। মিশরেই তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি সন্তানদের ওয়াসিয়ত করেছিলেন, মিশর ত্যাগকালে তার লাশ যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে যাওয়া হয়। ওয়াসিয়ত অনুযায়ী তার লাশ ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয়। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি বাইতুল মুকাদ্দাসে সমাহিত করা হয় (আতলাসুল কোরআন ৩৫)।

হযরত ইউসুফ (আ.)-এর শৈশব কাটে ফিলিস্তিনে

আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফ আ.। যার ঘটনাকে কোরআন আহসানুল কাসাস বলেছে। তিনি হযরত ইয়াকুব আ.-এর ছেলে। দক্ষিণ ইরাকের ফাদ্দান আরামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। এরপরই পিতা ইয়াকুব আ.-এর সঙ্গে ফিলিস্তিনে চলে আসেন। শৈশবের কিছুদিন ফিলিস্তিনেই কাটে তার। ছোটবেলায় তিনি ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। পরে নবুয়াত লাভ করার পর মিশরের মন্ত্রী হন।

নিজের পিতা ও ভাইদের মিশর নিয়ে আসেন। মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। তবে মৃত্যুকালীন ওয়াসিয়ত অনুযায়ী তার লাশকেও ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে স্থানান্তরিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৪৮ নম্বর পৃষ্ঠা)

ফিলিস্তিনের বাদশাহ ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)

হযরত দাউদ (আ.)। তিনি ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের বাদশাহ ও নবী ছিলেন। পাহাড়-পর্বত পাখিরা দাউদ আ. এর অনুগত ছিল। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি দাউদকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ দান করেছি। হে পাহাড়-পর্বত, হে পাখিরা, তোমরাও দাউদের সঙ্গে আমার তাসবিহ পড়। আর আমি তার জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলাম। (সুরা সাবা আয়াত নম্বর ১০)

নবুয়াত লাভের আগে তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তালুতের দলে যুদ্ধে শরিক হন। অত্যাচারী বাদশাহ জালুতকে তিনি হত্যা করেন। আসদুদ, বাইতে দুজান, আবু গাওস, বাইতুল মুকাদ্দাস ও রামলার শাসক ছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনেই ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে রামলাগামী পথের ডানপার্শ্বে একটি পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৬৪ নম্বর পৃষ্ঠা)

হযরত সুলাইমান (আ.)-এর মাতৃভূমি ফিলিস্তিন

হযরত সুলাইমান আ. হযরত দাউদ আ.-এর ছেলে। আল্লাহর নবী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গোটা পৃথিবী শাসনকারী শাসকদের অন্যতম। আল্লাহ তাআলা পশু-পাখি, বায়ুমণ্ডল ও জিন জাতিকে তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এই মহান নবীর জন্ম, বসবাস সবই ছিলো ফিলিস্তিন কেন্দ্রিক। তিনি ঐতিহাসিক বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদের নির্মাতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৯২৩ সালে ফিলিস্তিনে ইন্তেকাল করেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে তাকে দাফন করা হয়। (আতলাসুল কোরআন ৬৮ নম্বর পৃষ্ঠা)

ইয়াহইয়া (আ.)-এর জন্মস্থান ফিলিস্তিন

আল্লাহর আরেক নবী হযরত ইয়াহইয়া আ.-এর জন্ম লিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসে। হযরত জাকারিয়া আ.-এর দোয়ায় আল্লাহ তাআলা বৃদ্ধ বয়সে দান করেন ছেলে ইয়াহইয়া আ.-কে। তার মর্যাদা, তাকওয়া, জনপ্রিয়তা ও আল্লাহর দিকে আহ্বান-এর কারণে তিনি ইহুদিদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার কারণে বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরে তাকে শহিদ করা হয়। (কাসাসুল কোরআন ৭ নম্বর খণ্ড ৬২ পৃষ্ঠা)

কিয়ামতের আগে হযরত ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনেই নেমে আসবেন

ঈসা ইবনে মারইয়ামের জন্ম ফিলিস্তিনের বাইতুল লাহামে। যিনি পিতা ব্যতীত আল্লাহর কুদরতের সাক্ষী হিসেবে দুনিয়াতে আগমন করেন। তিনি দোলনায় থাকাবস্থায় নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দেন। মায়ের সতীত্বের সাক্ষ্য দেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন,

মারইয়াম বলল, আমার ছেলে হবে কীভাবে, অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি। আমি কোনো ব্যভিচারিণীও নই। ফেরেশতা বলল এভাবেই হবে। তোমার রব বলেছেন, আমার পক্ষে এটা একটি মামুলি কাজ। আমি এটা এজন্য করবো, যেনো একে আমি মানুষের জন্য নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে রহমত বানাতে পারি। এটি একটি স্থিরকৃত বিষয়। (সুরা মারইয়াম, আয়াত নম্বর ২০ ও ২১ )

তিনি ফিলিস্তিন অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করেন। মায়ের সঙ্গে মিশরেও গমন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে আবার ফিলিস্তিনে চলে আসেন। অভিশপ্ত ইহুদিরা তাকে জারজ সন্তান ও তার মাকে দুশ্চরিত্রা বলে অপবাদ দেয়। তিনি তাদের বিপক্ষে আল্লাহর কাছে বদ দোয়া করেন। আল্লাহর গজব নেমে আসে ইহুদিদের উপর।

তারা হযরত ঈসা (আ.)কে হত্যার পরিকল্পনা করে। আল্লাহ তাআলা তাকে নিজ কুদরতে জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নেন। কিয়ামতের আগে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে নেমে আসবেন। দাজ্জাল কে হত্যা করবেন। ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন। এরপর তার মৃত্যু হলে নবীজির রওজার পাশে সমাহিত হবেন।