১০:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

ভারতীয় কর্মকর্তাদের ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলতে বছরে ৩৫০০ কোটি খরচ করে পাকিস্তান!

  • ঢাকা ডেস্ক
  • সর্বশেষ আপডেট : ০৯:৩৭:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
  • 19

ছবি: সংগৃহীত

২০২২ সালের নভেম্বর। যৌনতার ফাঁদে পড়ে পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্মীকে। তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল। পুলি‌শের দাবি ছিল, তিনি ‘হানিট্র্যাপ’-এর শিকার।

এর আগে এবং পরেও পাক গুপ্তচর সংস্থার পাতা যৌনতার ফাঁদে পা দিয়ে দেশের গোপন তথ্য পাচার করার অভিযোগ কম নয়। ২০১৫ সালে ভারতীয় বায়ুসেনার অফিসার কেকে রঞ্জিতকে একই ভাবে ফাঁদে ফেলেছিল পাক গুপ্তচর সংস্থা।

২০০৮-এ ‘র’-এর অফিসার মনমোহন শর্মা চিনা শিক্ষিকার ‘হানিট্র্যাপ’-এ পড়ে দেশের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করেছিলেন। ২০০৭-এ ‘র’-এর আরও দুই অফিসার রবি নায়ার এবং কে ভি উন্নিকৃষ্ণণও এই ফাঁদে পড়ে তথ্য ফাঁস করেছিলেন বলে অভিযোগ।

‘হানিট্র্যাপ’-এ পড়ে দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত খবর ফাঁস করার অভিযোগ উঠেছিল প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধীর বিরুদ্ধে।

কিন্তু ‘হানিট্র্যাপ’ বা ‘মধুফাঁদ’ আসলে কী? পশ্চিমের দেশগুলিতে হানিট্র্যাপিং বিষয়টি খুব প্রচলিত। ইংরেজি সাহিত্যে ‘হানিট্র্যাপ’ শব্দটি প্রথম আসে জন লে ক্যারের লেখা ‘টিঙ্কার, টেলর, সোলজার, স্পাই’ নামক নভেলের মাধ্যমে।

১৯৭৪ সালে ওই নভেলেই প্রথম ‘হানিট্র্যাপ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে তা বহুল প্রচলিত হয়ে পড়েছে। সুন্দর কোনও নারী বা পুরুষকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে কারও কাছ থেকে গোপন নথি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদ পাতা হয়।

যে সব নারী বা পুরুষকে এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে নানা মুহূর্তের ছবি বা ভিডিয়ো তুলে তা দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করা হয় ‘টার্গেট’কে। অনেক সময় গোয়েন্দারা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ধরতে কাউকে ‘হানিট্র্যাপ’ হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন।

শীর্ষ ভারতীয় আধিকারিকদের ‘হানিট্র্যাপে’ ফেলার ছক কষার অভিযোগ অনেক দিন ধরেই উঠছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সে সংক্রান্ত তথ্যও বহু বার উঠে এসেছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার কর্তাদের একাধিক বার মহিলাদের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলার অভিযোগ উঠেছে পাক গুপ্তচর সংস্থার বিরুদ্ধে।

২০২২ সালের একটি রিপোর্টেও উঠে এসেছিল যে, মধুচক্রের ফাঁদে ধরা দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য পাকিস্তানি চরদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন ভারতীয় সেনার কিছু আধিকারিক।

রাজস্থান পুলিশের তরফেও দাবি করা হয়েছে, ২০১৯ সালের পর থেকে রাজস্থানে চরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতারির সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২১ সালে সংবাদমাধ্যমের পাতায় একটি খবর উঠে আসে যে, পাকিস্তান ‘অপারেশন হায়দরাবাদ’ নামে একটি অভিযানে ভারতের ২০০ সেনা সদস্যকে ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদে ফেলেছে।

খবরে উঠে আসে, অর্থনীতির হাল বেহাল থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় কর্তাদের হানিট্র্যাপ করার জন্য আইএসআইয়ে একটি বিশেষ বিভাগ বানিয়ে রেখেছে। ওই নির্দিষ্ট বিভাগটির জন্য নাকি বার্ষিক ৩৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দও করে ‘গরিব দেশ’।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ‘হানিট্র্যাপের’ প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ই খুলে ফেলেছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর। পাকিস্তানের স্থানীয় কলেজগুলি থেকে ৯০০ জন সুন্দরী তরুণীকে নিয়োগ করা হয়েছে সেখানে। ভারতীয় কর্তাদের যৌনতার ফাঁদে ফেলতে সেখানে নাকি ওই তরুণীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

যেভাবে ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলা হয়

পাক সেনার গোয়েন্দা ইউনিট ৪১২ সিন্ধ প্রদেশের হায়দরাবাদ থেকেও কাজ করে একটি ‘হানিট্র্যাপ’ মডিউল। কিন্তু কী ভাবে চলে সেই প্রশিক্ষণ? কী ভাবেই বা পাতা হয় ‘হানিট্র্যাপে’র ফাঁদ?

আরো পড়ুন: পাকিস্তানকে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে চীন, ঘুম হারাম ভারতের

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথমে ওই পাক তরুণীদের নাম বদলে পূজা, মুসকান, হরলিন, ববিতা ইত্যাদি রাখা হয়। এর পর চলে যৌনতার ফাঁদে ফেলার প্রশিক্ষণ। পঞ্জাবি, রাজস্থানি, হিন্দি এবং আরও বেশ কয়েকটি ভাষাও শেখানো হয় তাঁদের।

শুধু তাই-ই নয়, তাঁদের চালচলন, হাবভাব এবং পোশাক-আশাক কোনও কিছু দেখে বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় থাকে না যে এই মহিলারা পাকিস্তানের চর।

মিশন চালানোর জন্য কলেজছাত্রীদের পাশাপাশি স্থানীয় যৌনকর্মী এবং গরিব মহিলাদের কাজে লাগানো হয়। তাঁদের পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ প্রশিক্ষণ দেয়। পাক সেনার ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার আধিকারিকদের অধীনে এই মহিলাদের প্রশিক্ষণ চলে।

পাক সেনা এই মহিলাদের বিভিন্ন নামে পরিচয়পত্র তৈরি করে ভারতে হোটেল বুক করে দেয়। সেই সব হোটেল থেকেই ভারতে শিকার ধরার জাল ফেলেন তাঁরা। হোটেলের ঘরকে পারিবারিক ছবি দিয়ে আমূল বদলে ফেলা হয়।

যদি ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ফাঁদ পাতা হয়, তা হলে ওই তরুণীদের ঘরগুলিকে হিন্দু দেব-দেবীর ছবি দিয়ে এমন ভাবে সাজানো হয় যাতে কেউ তাঁদের অহিন্দু বলে সন্দেহ না করতে পারেন।

প্রথমে বন্ধুত্ব। নিজেদের ভারতীয় তরুণী বা মহিলা হিসাবে পরিচয় দেওয়া। তার পর আরও ঘনিষ্ঠ কথোপকথন। এবং শেষে নগ্ন ছবি বা ভিডিয়ো পাঠিয়ে সেনা বা পুলিশকর্মীদের জালে এমন ভাবে ফাঁসানো হয় যে, তাঁরা গড়গড় করে এ দেশের যাবতীয় তথ্য পাচার করে ফেলেন।

তার পরই শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং, হুমকি। ভয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতানো হয়।

ওই কৌশল ফেঁদে সফলতাও আসছে পাক গুপ্তচর সংস্থার। ২০২৩ সালের মে মাসে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গ্যানাইজ়েশন)-র বিজ্ঞানী প্রদীপ কুরুলকরকে।

তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদে পড়ে দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বেশ কিছু তথ্য পাক গুপ্তচর সংস্থার এক মহিলা কর্মীর কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

তদন্তে নেমে মহারাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমন শাখা (এটিএস) জানান, ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত গোপন তথ্য দেখাবেন বলে জানিয়েছিলেন ৫৯ বছরের ওই বিজ্ঞানী।

তদন্তে এ-ও উঠে আসে যে, জ়ারা দাশগুপ্ত নাম নিয়ে প্রদীপের সঙ্গে অনলাইনে আলাপ জমিয়েছিলেন পাক গুপ্তচর সংস্থার নিয়োগ করা এক তরুণী। জ়ারা নিজেকে লন্ডনের এক সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বলে দাবি করেছিলেন।

বেশ কিছু অশালীন ছবি ও মেসেজও তিনি ওই বিজ্ঞানীকে পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। প্রদীপ ডিআরডিও-র রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস্ট্যাবলিশমেন্ট (ইঞ্জিনিয়ার্স) ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ছিলেন।

২০২২ সালের ১০ জুন থেকে ২০২৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জ়ারার সঙ্গে প্রদীপের হোয়াট্‌সঅ্যাপের মাধ্যমে একটানা বার্তালাপ চলেছিল বলে সে সময় জানিয়েছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা।

অভিযোগ, ওই সময়ের মধ্যে জ়ারার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্রের গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখানোর কথা জানিয়েছিলেন প্রদীপ।

তবে শুধু ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্রই নয়, অগ্নি-৬, কোয়াডকপ্টারের মতো প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আরও নানা বিষয় প্রদীপের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন জ়ারা। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ, প্রদীপের মতো আরও একাধিক ভারতীয় কর্তা পাক গুপ্তচর সংস্থার পাতা যৌনতার ফাঁদে পা দিয়েছেন।

জ়ারার মতো পূজা, হরলিন, মুসকান, ববিতা নামের আড়ালেই চলছে যৌনতার বিশাল বড় নেটওয়ার্ক। শিকার হচ্ছেন ভারতীয় সেনা, পুলিশ, বিএসএফের জওয়ানেরা। যৌনতার টোপ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা-সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। নেপথ্যে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই।

নেটমাধ্যমে বন্ধুত্ব, যৌনতা, নগ্ন ছবি এবং তার পর লাগাতার ব্ল্যাকমেল— প্রক্রিয়াটা ঠিক এই ভাবেই চলে। আর গোটা প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে সীমান্তের ও পারে পাক গুপ্তচর সংস্থার হাতে।

উল্লেখ্য, কয়েক জন ‘হানিট্র্যাপের’ ফাঁদে পা দিলেও ভারতীয় কর্তাদের বেশির ভাগই ওই ফাঁদে পা দেন না। প্রতিনিয়ত ব্যর্থ করে চলেন পাক গুপ্তচর সংস্থার চাল।

আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সেভ করুন

ভারতীয় কর্মকর্তাদের ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলতে বছরে ৩৫০০ কোটি খরচ করে পাকিস্তান!

সর্বশেষ আপডেট : ০৯:৩৭:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

২০২২ সালের নভেম্বর। যৌনতার ফাঁদে পড়ে পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্মীকে। তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল। পুলি‌শের দাবি ছিল, তিনি ‘হানিট্র্যাপ’-এর শিকার।

এর আগে এবং পরেও পাক গুপ্তচর সংস্থার পাতা যৌনতার ফাঁদে পা দিয়ে দেশের গোপন তথ্য পাচার করার অভিযোগ কম নয়। ২০১৫ সালে ভারতীয় বায়ুসেনার অফিসার কেকে রঞ্জিতকে একই ভাবে ফাঁদে ফেলেছিল পাক গুপ্তচর সংস্থা।

২০০৮-এ ‘র’-এর অফিসার মনমোহন শর্মা চিনা শিক্ষিকার ‘হানিট্র্যাপ’-এ পড়ে দেশের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করেছিলেন। ২০০৭-এ ‘র’-এর আরও দুই অফিসার রবি নায়ার এবং কে ভি উন্নিকৃষ্ণণও এই ফাঁদে পড়ে তথ্য ফাঁস করেছিলেন বলে অভিযোগ।

‘হানিট্র্যাপ’-এ পড়ে দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত খবর ফাঁস করার অভিযোগ উঠেছিল প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধীর বিরুদ্ধে।

কিন্তু ‘হানিট্র্যাপ’ বা ‘মধুফাঁদ’ আসলে কী? পশ্চিমের দেশগুলিতে হানিট্র্যাপিং বিষয়টি খুব প্রচলিত। ইংরেজি সাহিত্যে ‘হানিট্র্যাপ’ শব্দটি প্রথম আসে জন লে ক্যারের লেখা ‘টিঙ্কার, টেলর, সোলজার, স্পাই’ নামক নভেলের মাধ্যমে।

১৯৭৪ সালে ওই নভেলেই প্রথম ‘হানিট্র্যাপ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে তা বহুল প্রচলিত হয়ে পড়েছে। সুন্দর কোনও নারী বা পুরুষকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে কারও কাছ থেকে গোপন নথি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদ পাতা হয়।

যে সব নারী বা পুরুষকে এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে নানা মুহূর্তের ছবি বা ভিডিয়ো তুলে তা দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করা হয় ‘টার্গেট’কে। অনেক সময় গোয়েন্দারা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ধরতে কাউকে ‘হানিট্র্যাপ’ হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন।

শীর্ষ ভারতীয় আধিকারিকদের ‘হানিট্র্যাপে’ ফেলার ছক কষার অভিযোগ অনেক দিন ধরেই উঠছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সে সংক্রান্ত তথ্যও বহু বার উঠে এসেছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার কর্তাদের একাধিক বার মহিলাদের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলার অভিযোগ উঠেছে পাক গুপ্তচর সংস্থার বিরুদ্ধে।

২০২২ সালের একটি রিপোর্টেও উঠে এসেছিল যে, মধুচক্রের ফাঁদে ধরা দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য পাকিস্তানি চরদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন ভারতীয় সেনার কিছু আধিকারিক।

রাজস্থান পুলিশের তরফেও দাবি করা হয়েছে, ২০১৯ সালের পর থেকে রাজস্থানে চরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতারির সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২১ সালে সংবাদমাধ্যমের পাতায় একটি খবর উঠে আসে যে, পাকিস্তান ‘অপারেশন হায়দরাবাদ’ নামে একটি অভিযানে ভারতের ২০০ সেনা সদস্যকে ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদে ফেলেছে।

খবরে উঠে আসে, অর্থনীতির হাল বেহাল থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় কর্তাদের হানিট্র্যাপ করার জন্য আইএসআইয়ে একটি বিশেষ বিভাগ বানিয়ে রেখেছে। ওই নির্দিষ্ট বিভাগটির জন্য নাকি বার্ষিক ৩৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দও করে ‘গরিব দেশ’।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ‘হানিট্র্যাপের’ প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ই খুলে ফেলেছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর। পাকিস্তানের স্থানীয় কলেজগুলি থেকে ৯০০ জন সুন্দরী তরুণীকে নিয়োগ করা হয়েছে সেখানে। ভারতীয় কর্তাদের যৌনতার ফাঁদে ফেলতে সেখানে নাকি ওই তরুণীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

যেভাবে ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলা হয়

পাক সেনার গোয়েন্দা ইউনিট ৪১২ সিন্ধ প্রদেশের হায়দরাবাদ থেকেও কাজ করে একটি ‘হানিট্র্যাপ’ মডিউল। কিন্তু কী ভাবে চলে সেই প্রশিক্ষণ? কী ভাবেই বা পাতা হয় ‘হানিট্র্যাপে’র ফাঁদ?

আরো পড়ুন: পাকিস্তানকে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে চীন, ঘুম হারাম ভারতের

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথমে ওই পাক তরুণীদের নাম বদলে পূজা, মুসকান, হরলিন, ববিতা ইত্যাদি রাখা হয়। এর পর চলে যৌনতার ফাঁদে ফেলার প্রশিক্ষণ। পঞ্জাবি, রাজস্থানি, হিন্দি এবং আরও বেশ কয়েকটি ভাষাও শেখানো হয় তাঁদের।

শুধু তাই-ই নয়, তাঁদের চালচলন, হাবভাব এবং পোশাক-আশাক কোনও কিছু দেখে বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় থাকে না যে এই মহিলারা পাকিস্তানের চর।

মিশন চালানোর জন্য কলেজছাত্রীদের পাশাপাশি স্থানীয় যৌনকর্মী এবং গরিব মহিলাদের কাজে লাগানো হয়। তাঁদের পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ প্রশিক্ষণ দেয়। পাক সেনার ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার আধিকারিকদের অধীনে এই মহিলাদের প্রশিক্ষণ চলে।

পাক সেনা এই মহিলাদের বিভিন্ন নামে পরিচয়পত্র তৈরি করে ভারতে হোটেল বুক করে দেয়। সেই সব হোটেল থেকেই ভারতে শিকার ধরার জাল ফেলেন তাঁরা। হোটেলের ঘরকে পারিবারিক ছবি দিয়ে আমূল বদলে ফেলা হয়।

যদি ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ফাঁদ পাতা হয়, তা হলে ওই তরুণীদের ঘরগুলিকে হিন্দু দেব-দেবীর ছবি দিয়ে এমন ভাবে সাজানো হয় যাতে কেউ তাঁদের অহিন্দু বলে সন্দেহ না করতে পারেন।

প্রথমে বন্ধুত্ব। নিজেদের ভারতীয় তরুণী বা মহিলা হিসাবে পরিচয় দেওয়া। তার পর আরও ঘনিষ্ঠ কথোপকথন। এবং শেষে নগ্ন ছবি বা ভিডিয়ো পাঠিয়ে সেনা বা পুলিশকর্মীদের জালে এমন ভাবে ফাঁসানো হয় যে, তাঁরা গড়গড় করে এ দেশের যাবতীয় তথ্য পাচার করে ফেলেন।

তার পরই শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং, হুমকি। ভয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতানো হয়।

ওই কৌশল ফেঁদে সফলতাও আসছে পাক গুপ্তচর সংস্থার। ২০২৩ সালের মে মাসে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গ্যানাইজ়েশন)-র বিজ্ঞানী প্রদীপ কুরুলকরকে।

তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদে পড়ে দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বেশ কিছু তথ্য পাক গুপ্তচর সংস্থার এক মহিলা কর্মীর কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

তদন্তে নেমে মহারাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমন শাখা (এটিএস) জানান, ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত গোপন তথ্য দেখাবেন বলে জানিয়েছিলেন ৫৯ বছরের ওই বিজ্ঞানী।

তদন্তে এ-ও উঠে আসে যে, জ়ারা দাশগুপ্ত নাম নিয়ে প্রদীপের সঙ্গে অনলাইনে আলাপ জমিয়েছিলেন পাক গুপ্তচর সংস্থার নিয়োগ করা এক তরুণী। জ়ারা নিজেকে লন্ডনের এক সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বলে দাবি করেছিলেন।

বেশ কিছু অশালীন ছবি ও মেসেজও তিনি ওই বিজ্ঞানীকে পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। প্রদীপ ডিআরডিও-র রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস্ট্যাবলিশমেন্ট (ইঞ্জিনিয়ার্স) ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ছিলেন।

২০২২ সালের ১০ জুন থেকে ২০২৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জ়ারার সঙ্গে প্রদীপের হোয়াট্‌সঅ্যাপের মাধ্যমে একটানা বার্তালাপ চলেছিল বলে সে সময় জানিয়েছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা।

অভিযোগ, ওই সময়ের মধ্যে জ়ারার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্রের গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখানোর কথা জানিয়েছিলেন প্রদীপ।

তবে শুধু ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্রই নয়, অগ্নি-৬, কোয়াডকপ্টারের মতো প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আরও নানা বিষয় প্রদীপের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন জ়ারা। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ, প্রদীপের মতো আরও একাধিক ভারতীয় কর্তা পাক গুপ্তচর সংস্থার পাতা যৌনতার ফাঁদে পা দিয়েছেন।

জ়ারার মতো পূজা, হরলিন, মুসকান, ববিতা নামের আড়ালেই চলছে যৌনতার বিশাল বড় নেটওয়ার্ক। শিকার হচ্ছেন ভারতীয় সেনা, পুলিশ, বিএসএফের জওয়ানেরা। যৌনতার টোপ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা-সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। নেপথ্যে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই।

নেটমাধ্যমে বন্ধুত্ব, যৌনতা, নগ্ন ছবি এবং তার পর লাগাতার ব্ল্যাকমেল— প্রক্রিয়াটা ঠিক এই ভাবেই চলে। আর গোটা প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে সীমান্তের ও পারে পাক গুপ্তচর সংস্থার হাতে।

উল্লেখ্য, কয়েক জন ‘হানিট্র্যাপের’ ফাঁদে পা দিলেও ভারতীয় কর্তাদের বেশির ভাগই ওই ফাঁদে পা দেন না। প্রতিনিয়ত ব্যর্থ করে চলেন পাক গুপ্তচর সংস্থার চাল।